প্রবন্ধ- মানবিকতা

মানবিকতা
– শচীদুলাল পাল

 

 

আহার নিদ্রা আর জীবন চক্রে সীমাবদ্ধ সমগ্র প্রাণীজগৎ। কিন্তু মানুষই একমাত্র প্রাণী যার মধ্যে আছে নানান গুণ। তার মধ্যে মানবিকতা প্রধান।
মানুষ হয়ে জন্ম নিলে মনুষ্যত্ব বোধ থাকবেই। কিন্তু আজ নানান কারনে মনুষ্যত্ব বোধ ভুলুন্ঠিত।
ভালো মন্দ বিচার করার ক্ষমতা, বিবেক, মনুষ্যত্ব, মানবিক মূল্যবোধের মানসিকতাই মানবিকতা। অহিংসা পরম ধর্ম, সব ধর্মের মূলমন্ত্র। কিন্তু কালপ্রবাহে ধর্মের নামে হানাহানি খুনোখুনিতে যুগযুগ ধরে সমাজ কলুষিত। ধর্ম মানে ধারণ করতে শেখায়। মানুষকে ভালোবাসো মানুষের মধ্যেই দেবতা মানুষই ভগবান। বিবেকানন্দ বলেছেন “জীবে প্রেম করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।”
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ”দেবতা নাই ঘরে তিনি গেছেন যেথায় মাটি ভেঙে করছে চাষা চাষ খাটছে বারোমাস।”
“গৃহহীনে গৃহ দিলে আমি থাকি ঘরে”
সনাতন হিন্দুদের কথায় যদি ধরা যায় তাহলে দেখা যায়। সত্য ত্রেতা দ্বাপর ও কলি এই চারযুগ। সত্য যুগে মানষের ছিল এক প্রকৃত আদর্শ মানবিকতা। অতিথি দেব ভবঃ। স্তন কেটে অতিথি সেবার কথা জানতে পারি।
মানুষ সৎ ছিল। বিবেক মনুষ্যত্ব মানবিক মূল্যবোধ প্রতিটি মানুষের মধ্যেই বিরাজমান ছিল। ত্রেতা যুগে সত্যযুগের আদর্শ অনেকটাই ম্লান, মানসিকতার ধীরে ধীরে অবনতি হতে লাগলো।
কৈকেয়ী নিজ পুত্রকে রাজ সিংহাসন দেবার জন্য রামচন্দ্রকে বনবাসে পাঠাতে দ্বিধাবোধ করছেন না। গুরু গৌতম ঋষির পত্নী অহল্যাকে শিষ্য ইন্দ্র সম্ভোগ করছেন।
দ্বাপরে কৃষ্ণ ও শকুনি ছল চাতুরির গুরু। কৃষ্ণ ছল চাতুরী দ্বারাই যুদ্ধে জয়লাভ করিয়েছেন।
এবার আসি কলিযুগে তিন যুগে যা যা মানবিকতা বাকি ছিল সব ধীরে ধীরে লোপ পেতে পেতে প্রায় তলানিতে ঠেকেছে।
প্রাচীন কালে আর্যগণ হিন্দুজাতিকে চারটি ভাগে ভাগ করে। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র।
নিয়মানুসারে ব্রাহ্মণ ছাড়া আর কারো বেদ পাঠের,বা
ওঁ শব্দ উচ্চারণ করার অধিকার নেই। কেউ যদি বেদপাঠ শ্রবণ করে ফেলে তাহলে তার কানে তপ্ত সীসা ঢেলে দাও। সমাজ সংস্কারক বিবেকানন্দ এই প্রথার বিলোপ ঘটিয়েছিলেন। বলেছিলেন এই নিয়ম কোথাও কোনো গ্রন্থে লিখিত নেই। এবং নিজে অব্রাহ্মণ হয়ে বেদ পাঠ করে বিশ্বের দরবারে হিন্দু ধর্ম প্রচার করেছেন।
সতীদাহ প্রথা রাজা রামমোহন রায় আইনবলে বিলুপ্তি করার
পূর্বে এক বাবা তার নয় বছর বয়সী কন্যাকে লালপাড় সাদা শাড়ি সিঁদুর আলতা পরিয়ে অশীতিপর বৃদ্ধ স্বামীর চিতার আগুনে ছুড়ে ফেলে সহমরণে পাঠাচ্ছেন। এ কোন মানবিকতা?
অন্তর্জলি যাত্রায় নাবালিকা সুন্দরী ব্রাহ্মণ স্ত্রী মরণাপন্ন বৃদ্ধ
সহ গঙ্গাতীরে সংসার পেতেছেন।
স্বামীর মৃত্যুর পর সহমরণে যাবে।
শবদাহের চন্ডাল তাকে ভালোবাসে। সে ইচ্ছা করলে চন্ডালের সাথে পালিয়ে যেতে পারতো।কিন্তু তা হয়না। চন্ডাল জলমগ্ন মেয়েটিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেও গ্রহণ করছে না।জলে তলিয়ে যাচ্ছে।এখানে বউটির মানবিকতা ও সমাজের অমানবিকতা পরিস্ফুটিত।
অনিচ্ছাকৃত রেগে মেগে তিন তালাক দিয়ে ফেললে তালাক গন্য হবে। ঠিক আছে?
কিন্তু আবার যদি ভুল করে এ কাজ হয়েই থাকে পুনরায় যদি আবার মিলন চাইলেই হবেনা, আবার স্ত্রীকে অন্যের সাথে নিকা করে তালাক দিয়ে ফিরে আসতে হবে। এ কোন মানবিকতা?
কুমারী মেয়ের যদি ফাঁসির সাজা হয় পাকিস্তানে তাহলে তাকে ফাঁসির আগে কারারক্ষীরা ধর্ষণ করবে।

পৃথিবীর সকল মানুষের যদি একটি ধর্ম থাকত তাহলে পৃথিবীতে এত ধর্মে ধর্মে যুদ্ধ, এত জঙ্গিবাদ, উগ্রবাদিতা আর হত্যার মতো নির্মম ঘটনা ঘটতো না।
মানুষ জন্মগতভাবে একটি ধর্মে বিশ্বাসী হয়, কিন্তু সে যখন পরিপূর্ণ, বিবেকবান আর সভ্য মানুষ হয় তখন মানবিক ধর্মটাকে প্রাধান্য দেওয়া যৌক্তিক বলে আমি মনে করি।  

মানুষের ধর্ম যদি মানবিকতা হতো, তাহলে ক্ষমতার জন্য, দম্ভের জন্য মানুষে মানুষে যুদ্ধ হতো না। পৃথিবীর প্রতিটি রাষ্ট্র যদি একটি করে মানবিক রাষ্ট্র হতো তাহলে একটি রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের অধিকার হরণ করত না, একটি রাষ্ট্র মানবিক হলে সে তার নিজের দেশের নাগরিকদের অধিকারও হরণ করে না। মানুষের মধ্যে যদি মানবিকতা থাকত তাহলে পৃথিবী আর স্বর্গের মধ্যে তফাৎ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হতো। পৃথিবীর এক অংশে দুর্ভিক্ষ আর অন্য অংশে প্রাচুর্যের পাহাড় থাকত না। সাম্য আর মানবতার বাণী সারা বিশ্বে একসাথে ধ্বনিত হতো।

বর্তমান সমাজে সামাজিক অমানবিকতা অবক্ষয় সমাজ। যে পিতামাতা দেবতুল্য যাদের ছাড়া অস্ত্বিত্বই নেই সেই পিতামাতা আজ সন্তান দ্বারা নির্যাতিত। আপন সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য আগের দিনে বৃন্দাবনে এখন বৃদ্ধাশ্রমে নির্বাসনে দিতে দ্বিধাবোধ করেনা।
স্ত্রী থাকতেও অন্য নারীর সাথে রাত কাটানো, স্বামী থাকতেও পরপুরুষের সাথে মিলনে এক বিষাক্ত অমানবিক অসামাজিক অবৈধতার বাড়বাড়ন্ত। সমাজ ও পরিবার ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। শিশু মনে এক মারাত্নক কুপ্রভাব সৃষ্টি করছে।ৎপরিবারে দু’ একটি বিবাহবিচ্ছেদ এখন জলভাত।
নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য আপনজনকে খুন করতে দ্বিধা করেনা।
একসময় ভারতবর্ষ পিতৃ সত্য পালনের জন্য রামের বনবাস, রাম লক্ষণের মতো ভ্রাতৃত্ব বোধের আদর্শ মেনে এসেছে। এখন সেই ভারতবর্ষে পিতামাতার কথামতো চলার বদলে জেনারেশন গ্যাপের দোহাই দিয়ে পিতামাতাকে অবজ্ঞা করা নিয়মে পরিনত হয়েছে। ভাই ভাইয়ের শত্রুতা এখন ঘরে ঘরের কাহিনী।
সিনেমা টিভির কুপ্রভাবেও সমাজ আজ মানবতা হীন।
আগে সিনেমায় একটা দৃশ্য কমন ছিল। একটা হিরোইনকে একা পেয়ে কখনো একা বা দলবল নিয়ে ধর্ষণ করতে উদ্যত হলে কোথা থেকে হিরো এসে উপস্তিত হয়ে মেয়েটিকে মারপিট করে নিজে ক্ষতবিক্ষত হয়ে নিজের জীবন বিপন্ন করে দুস্কৃতিদের হাত থেকে উদ্ধার করতো।
এখন সেখানে ইন্টারনেটের যুগে হট ফিল্ম, অপসংস্কৃতির শর্ট ফিল্ম কচি মনকে উত্তেজিত করছে। যার ফলে মেয়ে ধর্ষণের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। যা খুব কমই সংবাদে প্রকাশিত হচ্ছে।
বাধা দিলে নির্ভয়া কান্ডের মতো ঘটনা ঘটছে। আগে ডাকাতদেরও শপথ করতে হতো, নারীর গায়ে হাত দেবেনা। এখন পাশের বাড়ির কিশোর ছেলেটিও বিশ্বাস করা যায় না। মেয়েটির সর্বনাশ করছে তার সাথে নিজের ক্যারিয়ারও খতম করছে।
শিশু কন্যা ধর্ষণের মতো অতি জঘন্য ঘটনা ঘটে চলেছে। আদরের নামে আপনজন দ্বারাই ধর্ষিতা হচ্ছে।
আধুনিকতার নামে অনৈতিক অমানবিক কাজ চলছে।

কাঁচা ফল কারবাইড দিয়ে পাকিয়ে, মাছে বিষাক্ত ফরম্যালিন দিয়ে তরতাজা করে সব্জি আলু প্রভৃতিতে রঙ মিশিয়ে তরতাজা দেখিয়ে বাজারে বিক্রি হচ্ছে।
ঘিতে মৃত পশুর চর্বি, তেলে দুধে চা পাতায় ভেজাল দিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা মুনাফা লুটছে।
রাস্তায় কোন এক মুমুর্ষ দূর্ঘটনাগ্রস্ত ব্যাক্তিকে দেখে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। হয়তো তাকে সময়মতো হাসপাতালে পাঠানো হলে সে বেঁচে যেতো।
যোয়ান ছেলে বউমা সুখে আছে অথচ মা দোরে দোরে ভিক্ষা করছে।অমানবিক মুখ আমরা দেখছি। ফুটপাত বাসী নাবালিকাকে গাড়িতে উঠিয়ে ধর্ষণ করে গলা টিপে খালের ধারে ফেলে দিয়েছে এই সব অমানবিক ঘটনার খবর শুনে আমরা শিউরে উঠি।
2018 সালের পরিসংখ্যান অনুসারে ভারতে প্রতি ঘন্টায় ৫০ টি মহিলা ধর্ষিত হয়েছে। আর লজ্জা ও নিজেরই বদনাম হবে এই ভেবে অনেকেই পুলিশে জানায়নি, সংবাদেও আসেনি সেসব ধরলে প্রতি মিনিটে দুটি করে মেয়ে ধর্ষিত হচ্ছে।

আশারাম বাপু ও রাম রহিম ইনসানের মতো ধর্ম গুরুরা তাদের প্রভাবে কোটি কোটি শিষ্য তৈরি করে জনবল বাড়িয়েছে।
আশ্রমে নির্দ্বিধায় মেয়েরা দিনের পর দিন ধর্ষিতা হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ব্যভিচার চলার পর ধরা পড়ে এখন জেলে।

আজকের নির্বোধ বিবেকহীন স্বার্থপর আত্মকেন্দ্রিক সমাজের বুকে দাঁড়িয়ে মূল্যবোধের আশা না করাই ভালো।

কোরোনা আক্রান্ত ব্যাক্তির, ডাক্তার স্বাস্থ্য কর্মী, সাহায্যকারী ব্যাক্তিদের সাহায্য সমীহ করার পরিবর্তে তাদের হেনস্তা নিগৃহীত করা হচ্ছে। করোনা আক্রান্ত ব্যাক্তির মৃতদেহ সৎকারে বাধা দেওয়া হচ্ছে।

তবুও মানবিকতা প্রদীপ শিখার মতো টিম টিম করে জ্বলছে। মানবিকতা আছে বলেই
সমাজ সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়নি,য়টিকে আছে।
মানবিকতা আছে বলেই ঘর সংসার সমাজ দেশ টিকে আছে। নাহলে অরাজকতায় ভরে যেতো।খুনখারাবি, রাহাজানি, যুদ্ধ, জৈব অস্ত্র বা পারমাণবিক অস্ত্র প্রয়োগ করে এক দেশ অন্য দেশকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে দিত।

জীবকুলে মানুষ শ্রেষ্ঠ। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। সমাজে থাকতে গেলে সামাজিক ও মানবিক গুন থাকতে হবে। চরিত্র গঠনে মানবিকতা প্রধান গুন। মানবিক গুনসম্পন্ন মানুষ সমাজে সেবা পায়।
নিঃস্বার্থ ভালোবাসায় প্রকৃত ভালোবাসা। পরিবার, সমাজ দেশ জাতিকে নিঃস্বার্থ ভালোবেসে আত্মত্যাগের নাম মানবিকতা। মানবিক গুন সম্পন্ন সমাজ সংস্কারক মানুষ অবক্ষয় সমাজকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। তবেই আমূল-পরিবর্তন হবে।
গীতায় কৃষ্ণ বলছেন —

“যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত। অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্॥ পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশয় চ দুষ্কৃতাং। ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে॥”

Loading

Leave A Comment